সকালে বাবা বাসা থেকে বেড় না হওয়া পর্যন্ত ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে আকাশ । বাবার সামনা সামনি হলেই যে বকা বকি শুরু হয়ে যাবে । মা ডাকছে উঠ, আকাশ অনেক বেলা হয়েছে উঠ বাবা,নাস্তা করবি না ? তোর বাবা চলে গিয়েছে আর অভিনয় করতে হবে না । বাবা চলে গিয়েছে কথাটা শুনতেই শরীর থেকে কাঁথা সরিয়ে উঠে বসলো আকাশ । টেবিলে নাস্তা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে । মা অনেক সকালেই নাস্তা বানিয়ে রাখে । ভোরে ব্যায়াম করা থেকে ফিরে নাস্তা না পেলেই বাবার হইচই শুরু হয়ে যায় । আকাশ নাস্তা সেরে মাকে বললো মা বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়েছ ? -কিসের টাকা -গতকাল রাতে না তোমাকে বলেছিলাম আমার ৫০০ টাকা লাগবে । -আমার মনে ছিল না । এখন থেকে টাকা লাগলে তুই চেয়ে নিবি আমি চাইতে পারব না । তোর জন্য এমনিতেই প্রতিদিন আমাকে কথা শুনতে হয় । -আমি চাইতে পারব না । বাবার সামনে গিয়ে দাড়াতেই আমার ভয় লাগে । বাবাকে কিছু বললেই তো চিল্লা ফাল্লা শুরু করে দিবে । আমার এখন টাকা লাগবে তুমি দিবে । কিভাবে দিবে জানিনা । -আমার কাছে টাকা নাই । তোর বাবা আমাকে কোনও টাকা দেয়না জানিস না । তোর জন্য এখন টাকার গাছ লাগাতে হবে । -ঠিক আছে তাহলে তোমার টাকার গাছ থেকেই ছিঁড়ে আমাকে ৫০০ টাকা দাও । মা দাওনা.....দাওনা......। -আমার কাছে ৫০০ টাকা নেই ৩০০ টাকা আছে নিলে নিতে পারিস । -ঠিক আছে দাও ।
৩০০ টাকা নিয়ে আকাশ চলে গেলো কাশেম মামার চায়ের দোকানে । একে একে সব বন্ধুরা এসে হাজির । সারাদিন চায়ের দোকানে, নাহলে গলির মোড়ে,নাহলে মহল্লার কোনও চিপায় আড্ডা দেয়া ছাড়া আর কোনও কাজ নেই । মহল্লার মুরব্বিরা বলে ভাদাইম্মা গ্রুপ । সব ভাদাইম্মা গুলো এক সাথে হইছে । বিকেলে আড্ডা শেষ করে মহল্লার রহিম চাচার সাথে দেখা । -কিরে সারা জীবন কী এমনেই চলব ? বাপের হোটেলে আর কতদিন ? কাম-কাজ কী কিছু করবি না ? -জ্বি ! চাচা কাজ তো খুঁজছি । -সব সময় তো এই একই কথা বলিস কাজ খুঁজছি । তোদের তো ঐ কাশেমের চায়ের দোকান ছাড়া অন্য কোথাও যাইতে দেখিনা । কাজ খুঁজিস কখন? -না চাচা সত্যি সত্যি খুঁজছি । এখন আর আড্ডা দেই না । -দেখো বাবা এখন তোমার তরুণ বয়স এখন কাজ করার উপযুক্ত সময় । বয়সটাকে কাজে লাগাও । আর ঐ আবুল,বাবুলদের সাথে তুমি কী করো ? ওদের সাথে তুমি চলো না ওরা খারাপ ছেলে । -ঠিক আছে চাচা আমি যাই বাসায় যেতে হবে মা ফোন করেছিল কী জানি কাজ ছিল । -ঠিক আছে যাও । আকাশ বাসায় গিয়ে মাকে বললো মা ভাত দাও । -কেন যেই খানে ছিলি ওখানে কেউ ভাত দেই নাই ? সন্ধ্যা তো হয়েই গিয়েছে একবারে রাতে খেলেই তো হবে ।
খাওয়া শেষে মায়ের সাথে বসে টিভি দেখছে আকাশ । মা ভারতীয় টিভি চ্যানেল জি বাংলায় 'সাত পাকে বাধা' নাটক দেখছে । জি বাংলা মায়ের খুব প্রিয় চ্যানেলে পরিণত হয়েছে । রিমোট নিয়ে চ্যানেল পরিবর্তন করতেই মায়ের অভিযোগ চ্যানেল পরিবর্তন করলি কেন ? -সারাদিনই তো দেখো । এখন আমি একটু দেখি । -এখনই শেষ হয়ে যাবে বাবা তুই পরে দেখিস । -পরে আর কখন দেখবো একটু পরে তো বাবাই চলে আসবে তখন কী আর এই রুমে ঢুকতে পারব । -কেন পারবি না ? বাবার সাথে বসে দেখলে কী হয় ? -তুমি দেখো জ্বি বাংলা,বাবা দেখে খবর । আমার কী আর দেখার সুযোগ আছে । আমি বাইরে গেলাম তুমিই দেখো টিভি । বন্ধু বাবুলের সাথে দেখা । -কিরে মুখ কালো করে রেখেছিস কেন ? কী হয়েছে ? -আর বলিস না ! ভারতীয় চ্যানেল গুলোর কারণে টিভিও ঠিক মতো দেখতে পারিনা । সারাদিন শুধু মা নাটক দেখে । আমি কিছু দেখার সুযোগই পাইনা । এছাড়া সারাদিন বাবার বকা-ঝকা আর ভালো লাগে না । মাঝে মাঝে বাবা কী সব কথা যে বলে । খালি আমার দোষ খুঁজে । কবে যে এই সব কিছু থেকে মুক্তি পাবো । চিন্তা করছি বাংলাদেশেই আর থাকবো না বিদেশ চলে যাবো । বিদেশ গেলে আর কেউ বকা দিতে পারবে না ।
বাবা বাসায় ফেরার সময় আকাশকে দেখে বললো তারা তাড়ি বাসায় আয় । ঠিক আছে বলে, আকাশ বাসায় গেলো না । বাসা থেকে মায়ের ফোন কিরে আকাশ কই তুই তোর বাবা তোকে খুঁজছে কী জানি দরকার আছে । বাসায় গিয়ে আকাশ বাবার সামনা সামনি হলো ।
-কিরে তুই ওখানে কী করছিলি? আমি তোকে বললাম তুই আসলি না কেন? পকেট মাইরদের কাছ থেকে ভাগ নেয়ার জন্য দাড়িয়ে ছিলি ? দে... কত টাকা কামাই করেছিস দে... ! কিছু বললো না আকাশ মাথা নিচু করে বাবার কথা শুনছে । -আগামীকাল থেকে সন্ধ্যা আটটার মধ্যে বাসায় ফিরবি নাহলে ঘরে ঢুকা বন্ধ । কী মনে থাকবে আমার কথা । মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো আকাশ । -ঠিক আছে এখন যা ।
রাতে বিছানায় শুয়ার পর নানা রকম চিন্তা মাথায় ঘুরপাক করছে । ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত । হতাশা ! আর হতাশা । যতই বয়স বাড়ছে চিন্তা ততই বাড়ছে । কী যে হবে আমার কে জানে ।
সকালে বাবা টাকা দিয়ে বললো যা বাজার করে নিয়ে আয় । এখন থেকে তুই বাজার করবি । এর আগে আকাশ বাজারে গিয়েছে কিন্তু বাবা সব কিছু কিনে দিতো আকাশ শুধু বাসায় নিয়ে আসত । আজ নিজেকেই বাজার করতে হবে, দাম-দর করতে হবে । বাজার করে নিয়ে আসার পর বাবা হিসেব চাইল । হিসেব দিতে গিয়ে দেখে সে সব কিছু বেশি দাম দিয়ে কিনে এনেছে । বাবা বললো বাকি টাকা তুই মারিং করেছিস । ওদিকে মা বলছে আকাশ এগুলো কী মাছ এনেছিস সব মাছ তো পচা । বেগুন এনেছিস, সব বেগুনে পোকা । যা ফেরত দিয়ে আয় । আকাশ পড়ল বিপাকে কী করবে বুঝতে পারছে না । অভিমান করে বাসা থেকে বেড় হয়ে গিয়েছে । বন্ধুদের সাথে সিগারেট টানছে যেই মুখ থেকে ধোয়া বেড় করেছে ঠিক সেই মুহূর্তে বাবার সামনা সামনি । সাথে সাথে সিগারেট হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিলো আকাশ । আজ বাসায় আয় তারপর তোর বিচার করছি বলে বাবা চলে গেলো । মহা চিন্তায় পরে গেলো আকাশ । বাবার হাত থেকে আজ রেহাই নেই । বাবা এমনিতেই যেই রাগী টার উপর আবার কী এক কাণ্ড ঘটে গেলো । নাহ আজ বাসায় যাবো না ।
এর আগেও আকাশ অনেকবার অভিমান করে বাসায় যায় নি । এই তো গত মাসেই তো এক বন্ধুর বাসায় ছিল । রাতের বেলা মা গিয়ে বন্ধুর বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলো । এবার আর কোনও বন্ধুর বাড়িতে থাকা যাবে না । আমার সব বন্ধুর বাড়ি তো মা ও বড় ভাই চিনে । বন্ধুর বাড়িতে থাকলে ঠিকই খুঁজে বেড় করে ফেলবে । শীতের দিন শীতের কাপড়ও নিয়ে আসিনি । মনে মনে এই সব কথা চিন্তা করছে আকাশ । প্রচণ্ড খুদা পেয়েছে । রাত অনেক হয়েছে । পথে হাটতে হাটতে রাস্তায় পুলিশের গাড়ি । দুইজন পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে এসে জিজ্ঞাসা করল এই এত রাতে এখানে কী । আমার দাদু অসুস্থ তো তাকে দেখতে হাসপাতালে যাচ্ছি বললো আকাশ । আচ্ছা ঠিক আছে বলে পুলিশরা আকাশকে যেতে বললো । ক্লান্ত শরীরে আর হাটতে ইচ্ছা করছে না । পথে বসে পড়ল । পাশেই একজন লোক কাঁথা মোড়া দিয়ে ঘুমিয়ে আছে । শীত লাগছিল তাই আকাশ লোকটির কাঁথা একটু সরিয়ে নিজের গা ঢাকার চেষ্টা করছিল । ততক্ষণে লোকটি জেগে উঠলো বললো এই মিয়া আমার কাঁথা নিয়া টানাটানি করো কে । যাও অন্য হেনে গিয়া ঘুমাও । কী মহা বিপদ ফকিররাও ঝারি মারে । বুঝতে পারছে নিজের বাড়ি ছাড়া আর কোথাও ঠাই নেই বাড়িতে ফিরে যেতে হবে । একটু একটু অনুসুচনা হচ্ছে মা-বাবা ছাড়া আর কেউই আপন না । মা-বাবা যা করে ভালোর জন্যই করে । এইবার যদি বাবা কিছু না বলে তাহলে আর কোনদিন এরকম করবো না, ভালো হয়ে যাবো,বলে সিদ্ধান্ত নিলো । সকালে বাড়িতে ফিরে গেলো । গেট নক করতেই মা দরজা ঘুলে বললো কোথায় ছিলি সারা রাত । আমি আর তোর বাবা সারারাত ঘুমাতে পারিনি তোর চিন্তায় । -বাবা কই ? -আছে ! আয় কিছু বলবে না । আমি তোর বাবাকে বলেছি ।
আকাশ ঘরে ঢুকতেই বাবা বললো আকাশের মা আকাশকে নাস্তা দাও । বাবার নরম সুরে আকাশের চোখের কনে জল চলে এলো । নাস্তা শেষে বাবা আকাশকে ডেকে বললো----- -তুই কী করবি বলতো ? এভাবে চলবে ? -আমাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিন, আমি বিদেশে যাবো । -বিদেশ গিয়ে তুই কী করবি ? তুই কোনও কাজ পারিস ? -আমি এত কিছু জানিনা, আমি বিদেশ যাবো । -শোন বাবা বিদেশে অনেক কষ্ট । বিদেশে তুই আমাদের কাউকে পাবি না । এখানে তোর যদি কোনও সমস্যা হয় আমরা সবাই আছি । বিদেশে কোনও সমস্যা হলে তোকে কে দেখবে? তুই থাকতে পারবি না । - আমি পারব বলে জেদ ধরল আকাশ । -ঠিক আছে আমি তোকে বিদেশ পাঠাবো । কিন্তু দুই মাস পর ফিরে আসতে পারবি না । -ঠিক আছে আসবো না ।
ক'মাস পরে সব কিছু ঠিক হলো । মনে অনেক আনন্দ । বন্ধু বান্ধব সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়া হয়েছে । রাতের ফ্লাইটে আকাশ কানাডা যাচ্ছে । সবাইকে বিদায় জানিয়ে বিমান বন্দরের ভিতরে প্রবেশ করল । অনেক স্বপ্ন । বিমানে উঠে বসার পর কেমন কেমন জানি লাগছে । বিমান ছাড়ার পর খুব কান্না পাচ্ছে । মনে হচ্ছে সবার কাছ থেকে অনেক দুরে চলে যাচ্ছে । আর কোনদিন মনে হয় কারও সাথে দেখা হবেনা । নিজেকে খুব একা লাগছে । দুপুরে বিমান কানাডা বিমান বন্দরে অবতরণ করল । বিমান থেকে নামার পর সব কিছুই অন্য রকম লাগছে । ইচ্ছে করছে আবার ফিরে যাই । কিন্তু না বাবাকে কথা দিয়েছে আকাশ । অচেনা দেশ, অচেনা মানুষ । পরিচিত একজন এসে আকাশকে বিমান বন্দর থেকে নিয়ে গেলো তার বাড়িতে । এই বাড়িটিতেই আকাশকে এখন থেকে থাকতে হবে । নতুন ঠিকানা । বাবা মায়ের কথা খুব মনে পরছে । সারারাত ঘুম হয়নি । সপ্তাহ খানেক পর একটি কাজ ঠিক হলো । সকাল দশটা থেকে রাতের দশটা পর্যন্ত কাজ ।
শুরু হলো কর্মজীবন । জীবনে প্রথম কাজ করছে আকাশ । সারাদিন কাজ করে রাতে বাড়িতে ফিরে শরীর আর যেন চলেনা । বিদেশ নিয়ে মানুষের মুখে কত কথায় না শুনেছে আকাশ । বাস্তবে এসে বুঝতে পারছে বিদেশ যে কত কষ্টের । রঙিন স্বপ্ন গুলো আস্তে আস্তে করে সব সাদা কালো হয়ে যাচ্ছে । বাস্তব জীবন যে কত কষ্টের তা বুঝতে পারছে । রান্না করতে গেলে মায়ের কথা খুব মনে পরে । মনে হতো মা যেন কিছুই করেনা । কিন্তু এখন বুঝতে পারছে মা কত কাজই না করে । বাবা কত পরিশ্রম করে আমাদের বড় করেছে বুঝতে পরেছে আকাশ । বাস্তবতা আসলেই খুব কঠিন । বিদেশ আসার পর বাবার কথায় কেমন জানি ভিন্নতা চলে এসেছে । আগে বাবা ডাকত তুই করে, কিন্তু এখন যখন মোবাইলে কথা বলে বাবা তুমি করে ডাকে । প্রতিদিন বাবা ফোন করে জিজ্ঞাসা করে কেমন আছিস ? কিছু লাগবে তোর ? আকাশ উত্তর দেয় আমি ভালো আছি বাবা । কিছু লাগবে না । খুব ভালো আছি । আকাশ বলতে পারেনা বাবা আমি ভালো নেই, কষ্টে আছি । আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান । বললেই তো বাবা-মা চিন্তা করবে ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সেলিনা ইসলাম
সমসাময়িক সমাজ চিত্র বেশ সাবলীভাবেই তুলে ধরেছেন -গল্পের শেষটা প্রবাস জীবনের যে চিত্র এঁকেছেন তা থেকে স্পষ্টত হয় কঠিন বাস্তবতা যা দেশে বাবা মায়ের সান্নিধ্যে থেকে কখনোই উপলব্ধি করা সম্ভব নয় । ধন্যবাদ
আসলে প্রবাস নিয়ে আমরা যে রঙিন স্বপ্ন দেখি তা বাস্তবে পুরোটাই ভিন্ন। যুব সমাজের যারা প্রবাস নিয়ে রঙিন স্বপ্ন দেখেন তাদের উদ্দেশ্যে এই গল্পটা লেখা। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সময় করে মন্তব্য করার জন্য।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।